মানবাধিকার পরিস্থিতি কতটা নাজুক

যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রতি বছর নিজ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। সারাবিশ্বে সেটা ছড়িয়ে দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয় কোন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির কী হাল। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। পাঠককে ইলহান ওমর নামে সোমালীয় বংশোদ্ভূত একজন মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
ইলহান ওমরের বয়স ৩০-এর কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের মিনিসোটা অঙ্গরাজ্য থেকে তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে সে দেশের কংগ্রেস সদস্য (আইন প্রণেতা) নির্বাচিত হন। জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। কেনিয়ার শরণার্থী শিবিরে একজন বালিকা হিসেবে প্রথম জীবন কাটিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব মিলেছে। উচ্চশিক্ষিত ইলহান তাঁর যোগ্যতায় কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় কমিটিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে, তিনি আফ্রিকা ও আরব দেশগুলোতে কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তা নিয়ে সব সময় সোচ্চার থাকতেন। মাসখানেক আগে ইলহান কংগ্রেসে দাঁড়িয়ে বেশ উচ্চকণ্ঠে ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনে কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তা তুলে ধরে জোরালো প্রতিবাদ জানান। এটি ইলহানের জন্য কাল হয়ে গেল। কয়েক দিন পরই ইলহান ওমর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটি থেকে অপসারিত হলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাস করে এসব বিষয়ে কথা বলা একেবারেই হারাম। সেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বাছাই করা দেশের মানবাধিকার নিয়ে প্রতি বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে চারদিকে নিন্দিত হয়।
২০২২-এর এমন প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো এবং তাতে যথারীতি বাংলাদেশসহ অনেক দেশের মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উষ্মা প্রকাশ করল। সেখানে তেমন গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ নেই মিয়ানমার বা ইসরায়েলের। তামাম মধ্যপ্রাচ্য ও লিবিয়াকে তছনছ করে দিল সাবেক বুশ প্রশাসন। সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিল। কোনো দেশ সিরিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাখতে পারবে না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে উপনীত, সম্প্রতি তুরস্ক ও সিরিয়াতে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হলো, সারাবিশ্ব এগিয়ে এলো তুরস্ককে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা দিতে। যে দু’একটি দেশ সাহস করে সিরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অন্যরা স্যাংশনের ভয়ে দূরে থেকেছে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কোনো সুশীল বা সংস্থাকে কথা বলতে শোনা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে ২০১৮ সালের নির্বাচনবিষয়ক তথ্য (যা থাকার কথা ছিল পরের বছরের প্রতিবেদনে) আছে। বাংলাদেশ নাকি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দেয়; গণমাধ্যমে আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাকি নেই; সরকার বিচার ব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ করে। আরও আছে দুর্নীতির প্রসঙ্গ। পরের অভিযোগটায় আগে আসি। দুর্নীতি যে কিছুটা লাগামহীন হয়েছে, তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে চারদলীয় জোট সরকারের আমলের সঙ্গে তুলনীয় যেটা– বর্তমান সময়ে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের বিচার হচ্ছে। জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। বর্তমানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যে অবস্থান, তা আরও জোরদার করতে হবে– এটি বলার অপেক্ষা রাখে না। আর শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা? হরদিন বিএনপিসহ যারা বর্তমান সরকারকে টোকা দিয়ে ফেলে দিতে চায়, তারা তো দেশের কোথাও না কোথাও মাইক লাগিয়ে সরকার আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা? দেশে এখন ৪৪টি টিভি ও ২০টি বেসরকারি রেডিও আছে, যেখানে যার যা ইচ্ছা বলতে পারেন।

বিএনপি বা তাদের মিত্ররা যদি একটি জনবহুল রাজপথ দখল করে গলাবাজি করতে চায়, তা বাধা দেওয়ার আইনগত ক্ষমতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটন আইল্যান্ডের টাইম স্কোয়ারে যদি কেউ সমাবেশ করতে চায়, তা কি সেই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করতে দেবে? বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ তো দলীয় অফিসের সামনে ১৪ ফুট কাঁটাতারের ভেতর পাঁচ বছর সমাবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। সেই সমাবেশেও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড মেরে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যার চেষ্টা করেছে বিএনপি চেয়ারপারসনের পুত্র তারেক রহমানের নেতৃত্বে এক দল দুর্বৃত্ত। তখন কোথায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ে কান্না? ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে ২০২৩ সালে কথা বলার মধ্যে এক ধরনের দুরভিসন্ধি থাকা বিচিত্র নয়। কারণ আর কয়েক মাস পরেই দেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে যে কোনো উপায়ে বিএনপির পলাতক চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ক্ষমতায় বসাতে অনেক সুশীল ও সংগঠন প্রকাশ্যে ও গোপনে তৎপর। এই প্রতিবেদন তাদের চাঙ্গা করবে।
গত বুধবার ঢাকার এক সমাবেশে বিএনপির নেতারা বেশ জোর গলায় বললেন– যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে দেশের মানুষ লজ্জিত। দেশের মানুষ এই প্রতিবেদনে লজ্জিত হয়নি। দেশের মানুষ লজ্জিত হয়েছিল যখন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইর একটি তদন্ত দল ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নাইকো দুর্নীতি মামলা তদন্ত করতে পাঁচবার বাংলাদেশ সফরে এসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে বিশ্বকে জানিয়ে দিল– খালেদা জিয়া ও তাঁর পুত্র তারেক রহমান নাইকো জ্বালানি কোম্পানি থেকে এক বিশাল অঙ্কের অর্থ উৎকোচ নিয়েছেন। মামলাটি যেহেতু এখনও বিচারাধীন, সেহেতু যতটুকু দেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং এফবিআইর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে, তা-ই বলা হলো। দেশের মানুষ লজ্জিত হয়েছিল যখন বিশ্বখ্যাত ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন তাদের ২০০৭ সালের এক সংখ্যায় প্রকাশ করেছিল– ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে কাজ পেতে জার্মানির সিমেন্স কোম্পানি জিয়ার পুত্র কোকোকে কত কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিল তখন।
আসি র‍্যাবের ওপর স্যাংশন বিষয়ে। এই এলিট ফোর্সটি গঠিত হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। প্রথম ধাক্কায় তারা ৫৯ জনকে সন্ত্রাসী তকমা লাগিয়ে বিনা বিচারে হত্যা করল, যাদের বেশিরভাগই বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী। পাঠকের জামাল ফকিরের কথা নিশ্চয় মনে আছে। নিরীহ জামালকে র‍্যাব হত্যা করেছিল সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে। সেই সময় র‍্যাবের এসব হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার জন্য তৎকালীন সরকার সংসদে দায়মুক্তি আইন পাস করেছিল। তখন কোথায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার দলিল? বর্তমান সরকারের আমলে নারায়ণগঞ্জে র‍্যাবের হাতে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র‍্যাবের ৬ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্যের জামাতাও আছেন। এই ঘটনা কি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানে না? র‍্যাব যে দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সফলভাবে কাজ করেছে, তাতে মনে হয় স্টেট ডিপার্টমেন্ট খুশি নয়। আর র‍্যাবের কিছু কর্মকর্তার ওপর যে অভিযোগে স্যাংশন দেওয়া হয়েছে, একই অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্রের পুরো পুলিশ বিভাগকেই অভিযুক্ত করা যায়। আসলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি, বাংলাদেশসহ অনেক দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তারা সম্ভবত তাদের সেই গুরুত্বটা বুঝতে পারছে না এবং নানা ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ডে তাদের অবস্থানকে নড়বড়ে করে ফেলছে। তারা এও বুঝতে পারছে না– বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্য তাদের অজান্তে সরে যাচ্ছে।
আবদুল মান্নান: বিশ্লেষক ও গবেষক
বিষয় : সমকালীন প্রসঙ্গ আবদুল মান্নান যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মানবাধিকার পরিস্থিতি

Add a Comment