কঠিন সময়ে নতুন রাষ্ট্রপতির করণীয়

রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হলে কে হচ্ছেন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি, তা নিয়ে দেশে ও বাইরে জল্পনাকল্পনা চলেছে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, যিনিই হোন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি তাকে হতে হবে একজন পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক, গণতন্ত্রের প্রতি তার থাকতে হবে প্রশ্নাতীত আনুগত্য আর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে তাকে নিতে হবে দেশের স্বার্থে বিবেচনাপ্রসূত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, সমুন্নত রাখতে হবে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে লিখিত সংবিধানের পবিত্রতা। মিডিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছিল অনেকের নাম।

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা থেকে সাবেক প্রধান বিচারপতি- অনেকেই ছিলেন সেই তালিকায়। আওয়ামী লীগের ভেতরেও দুই ধরনের মত ছিল। একজন সাবেক আমলাকে বিবেচনা করা উচিত নাকি দলের ভেতরের কোনো রাজনীতিবিদ। মনে করা হচ্ছিল, বিষয়টি দলের সভায় মীমাংসিত হবে। তা নয়, সবাই সিদ্ধান্তের জন্য ছেড়ে দিলেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার ওপর। তার ওপর দলের নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস আকাশচুম্বী। তিনি দেশের ক্রান্তিকালে অতীতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেননি। বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১৪ সালের নির্বাচন, পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্র যেভাবে সামাল দিয়েছেন, তা এক কথায় অনন্য।

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন রবিবার (১২ ফেব্রুয়ারি)। কেউই নিশ্চিত নন কে হচ্ছেন বাইশতম রাষ্ট্রপতি। চারদিকে কানাঘুষা। সকালে গণভবনে ডাক পড়ল আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মো. সাহাবুদ্দিনের। শেখ হাসিনা তাকে জানালেন তার সিদ্ধান্তের কথা। সাহাবুদ্দিন অনেকটা বাকরুদ্ধ। বেলা ১১টা নাগাদ দলের সাধারণ সম্পাদক অন্য নেতাদের নিয়ে ছুটলেন নির্বাচন কমিশনে। যিনি মনোনয়ন পেলেন তিনি গেলেন পৃথকভাবে। জমা দেওয়ার পর জানা গেল এত দিন যাদের নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলছিল, তাদের কেউ নন, শেখ হাসিনা এমন একজনকে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পদের জন্য বাছাই করেছেন যিনি ২৪ ঘণ্টা আগেও জানতেন না এই বাছাইয়ের কথা। শেখ হাসিনার বাছাই করা ব্যক্তিটি আর কেউ নন দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মো. সাহাবুদ্দিন; যা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি। সাহাবুদ্দিন ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন সাহসী কমিশনার। তার আগে জেলা ও দায়রা জজ। বাস্তবে শুধু যে দলের নেতাকর্মীদের শেখ হাসিনা অবাক করেছেন তাই নয়, অবাক করেছেন দেশের মানুষকেও। বেলা ১টা নাগাদ কলকাতা থেকে একজন সাংবাদিক আমাকে ফোন করলে তাকে আমি খবরটা নিশ্চিত করি। তাকে বাংলাদেশের বাইশতম রাষ্ট্রপতির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিই। অনেকের প্রশ্ন- কেন মো. সাহাবুদ্দিন? তিনি তো একজন আমলা। দলে তো অনেক সিনিয়র রাজনীতিবিদ আছেন। তাদের বলি, এটি রাজনীতিবিদ বা আমলার ব্যাপার নয়, ব্যাপার হচ্ছে যোগ্য, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারার প্রতি আনুগত্য, সততা আর সাহস; যার প্রতিটি মাপকাঠিতেই সাহাবুদ্দিন উতরে গেছেন। ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় নামলে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশের প্রথম সেনাশাসক জেনারেল জিয়া তাকে জেলে পোরেন এবং সেখানে তিনি তিন বছর বন্দি ছিলেন।

উত্তরবঙ্গ থেকে সাহাবুদ্দিন হবেন তৃতীয় রাষ্ট্রপতি আর প্রথম বৈধ রাষ্ট্রপতি। এর আগে এ পদটি জবরদখল করেছিলেন জেনারেল জিয়া আর জেনারেল এরশাদ। তারা দীর্ঘদিন এই সম্মানিত পদটি দখলে রেখে পদটিকে অসম্মান করেছেন। প্রথমজন সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন আর দ্বিতীয়জন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।

আর কোনো প্রার্থী না থাকায় বুধবার নির্বাচন কমিশন সাহাবুদ্দিনকে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছে। ২৪ এপ্রিল বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের মেয়াদ শেষ হলে নতুন রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নেবেন। যদি এ পদের জন্য অন্য কোনো প্রার্থী থাকত, তাহলে সংসদ সদস্যরা সংসদে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতেন। যেহেতু সংসদে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, ভোট হলেও তাতে ফলাফলের কোনো ব্যত্যয় হতো না।

শেখ হাসিনার সাহাবুদ্দিনকে মনোনীত করার পেছনে একাধিক কারণের মধ্যে তার রাজনৈতিক অতীত। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রলীগের ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি, জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সভাপতি পদ অলংকৃত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসেছেন। তবে সাহাবুদ্দিনের সবচেয়ে সাহসী কীর্তি ছিল পদ্মা সেতু ঘিরে উত্থাপিত তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ কেন্দ্র করে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা। বিশ্বব্যাংক এক টাকা না দিয়েও দাবি করল পদ্মা সেতু নির্মাণে বড় মাপের দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। একশ্রেণির মিডিয়া ও আওয়ামী লীগবিরোধী সুশীল ব্যক্তি এ খবরে বেশ উজ্জীবিত হয়ে চারদিকে হইচই ফেলে দিল। অভিযোগের তির তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দিকে। সঙ্গে আরও যোগ হলো যোগাযোগ সচিব মোশাররফ হোসেন ভুইয়া ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের নাম। তিন সুশীল ব্যক্তির একটি শক্তিশালী দল ছুটলেন ওয়াশিংটনে। দরবার করলেন বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে- কোনো অবস্থায়ই যেন বাংলাদেশকে পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ দেওয়া না হয়। বিশ্বব্যাংক লুই মোরিনো ওকাম্পোর নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত দল পাঠাল বাংলাদেশে অভিযোগ তদন্তে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে অভিযোগের তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। ওকাম্পো এসে ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে বৈঠক করলেন বঙ্গবন্ধুর কৃপাধন্য একজন সাবেক রাজনীতিবিদ ও দুটি পত্রিকার অত্যন্ত ক্ষমতাধর সম্পাদকের সঙ্গে। জেনে নিলেন বাংলাদেশের আইনকানুনের সব বিষয়। পরদিন ওকাম্পো দলবল নিয়ে অত্যন্ত মারমুখী হয়ে দেখা করলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত কর্মকর্তা সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে। তাদের দাবি- কোনো সময় ক্ষেপণ না করে এই মুহূর্তে গ্রেপ্তার করতে হবে যোগাযোগ মন্ত্রী ও সচিবকে। সাহাবুদ্দিন জানিয়ে দিলেন কোনো প্রমাণ ছাড়া কীভাবে তিনি গ্রেপ্তারের হুকুম দেন। পরের অধ্যায় আরও বেদনাদায়ক। সাহাবুদ্দিনের ডাক পড়ল একজন ডাকসাইটে মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার বাসভবনে। তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হলো বিশ্বব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের। সাহাবুদ্দিন তার আগের সিদ্ধান্তে অটল। প্রমাণ ছাড়া কী করে তিনি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন! এসব কথা সাহাবুদ্দিন অকপটে মিডিয়ার সামনে বলেছেন। এগুলো কোনো রাখঢাকের ব্যাপার নয়। সেই মো. সাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনীত করে শেখ হাসিনা ভুল করেননি।

বাইশতম রাষ্ট্রপতির সামনে এ মুহূর্তে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ সুষ্ঠুভাবে সংবিধান সমুন্নত রেখে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করা; যদিও কাজটি খুব সহজ বলে মনে হচ্ছে না। কারণ দেশের অন্য বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের ওয়ানম্যান পার্টির মিত্ররা বর্তমান সরকারকে ফেলে দিয়ে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া। তাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে দু-একটি পশ্চিমা দেশ, এ দেশের কিছু মিডিয়া। নেতৃত্ববিহীন বিএনপি বর্তমানে গভীর সমুদ্রে দিকহারা নৌকার মতো। তাদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দেশের মানুষকে ২০১৩-১৫ সালের মতো জিম্মি করতে আবারও প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী দিনের কঠিন সময়ে নতুন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের করার আছে অনেক কিছু। কিন্তু তিনি যদি বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের ২০০১ সালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে মানুষ হতাশ হবে। তবে তার আগের রেকর্ড বলে, তিনি তা করবেন না। ভাঙবেনও না, মচকাবেনও না। প্রমাণ করবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা তার ওপর যে আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছেন তিনি তার যোগ্য। বাইশতম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শেখ হাসিনা যে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তিনি আবারও প্রমাণ করেছেন তার বিকল্প তিনি নিজেই, অন্য কেউ নন। দেশ ও জনগণের স্বার্থে শতায়ু হোন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা- সবার এই প্রত্যাশা। বাইশতম রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে আগাম অভিনন্দন।

 

 

Source: protidinerbangladesh, 15 February, 2023

Link: https://protidinerbangladesh.com/opinion/25429/%E0%A6%95%E0%A6%A0%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AA%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A3%E0%A7%80%E0%A7%9F