বাংলাদেশের জন্য নিরন্তর আশীর্বাদ শেখ হাসিনা
২৮ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের প্রাধনমন্ত্রীর ৭৫তম জন্মদিন। ৭৫তম জন্মদিনে তাঁকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।
শেখ হাসিনা যখন তাঁর ৭৫তম জন্মদিনে তখন বাংলাদেশ তার জন্মের ৫০ বছর পার করে এসেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষও পার হয়ে গেছে গত মার্চ মাসে। এই দিক থেকে গত এক বছর বেশ ঘটনাবহুল। কভিড-১৯-এর কারণে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষে প্রায় সব পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠানের কিছুটা রদবদল করতে হয়েছে। পাল্টাতে হয়েছে তার ধরন। কিন্তু কোনো কিছুই থেমে থাকেনি। গত বছর যখন কভিড-১৯ সংক্রামণ তুঙ্গে তখন শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি অনলাইনে অংশ নিয়েছিলেন। সেই বছর বিশ্বের খুব কম নেতাই বিশ্বসভার এই বার্ষিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরেছেন। তবে শুক্রবার নিউ ইয়র্ক সময় সকাল সাড়ে ১১টায় শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ১৮তম ভাষণটি দিয়ে এক অনন্য বিশ্বরেকর্ড স্থাপন করেছেন। এর মধ্যে যেমনটি বলেছিলাম গত বছর ছাড়া তিনি সশরীরে উপস্থিত থেকে একটি দেশের একজন নির্বাচিত সরকারপ্রধান হিসেবে ১৭টি ভাষণ দিয়ে যে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন, যা সম্ভবত দীর্ঘদিন অটুট থাকবে।
বছর কয়েক আগে শেখ হাসিনা বেশ কিছু তরুণ-তরুণীকে নিয়ে গণভবনে বসেছিলেন তাঁর নিজের কথা বলতে। এক তরুণী বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে জানতে চাইলেন তিনি যখন ছোট ছিলেন তখন তিনি কী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। আমাদের ছোটবেলায় একটি সাধারণ প্রশ্ন ছিল—‘বড় হলে কী হতে চাও’? আজকের প্রজন্মের কাছে এমন প্রশ্ন তেমন একটা কেউ করে না। করলেও তেমন একটা উত্তর জানা থাকে না অনেকেরই। শেখ হাসিনা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বলেছিলেন, তিনি ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন বড় হলে ডাক্তার হবেন; তবে এইচএসসি পরীক্ষায় অঙ্কে ভালো নম্বর না পাওয়ায় তিনি ঠিক করেছিলেন স্কুলের শিক্ষক হবেন। ভাগ্য তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি, তবে তিনি বর্তমান সময়ে দেশের জন্য অনেক বিষয়ে শিক্ষক।
শেখ হাসিনা রাজনীতিতে আসবেন তেমনটা কেউ ভাবেননি বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায়। ঘটনাচক্রে তাঁকে রাজনীতিতে আসতে হয়েছে এবং তিনি বাংলাদেশের জটিল রাজনীতিতে আশীর্বাদ হয়েই এসেছেন। বিশ্বনেতারা শেখ হাসিনাকে একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখেন। তাঁর নেতৃত্বে একটি স্বল্পোন্নত দেশ কিভাবে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে উঠতে পারে তার প্রশংসা করতে বিশ্বসম্প্রদায় কখনো কার্পণ্য করেনি। পিতা দেশটাকে তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে অনুন্নত (underdeveloped) দেশ থেকে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশে (least developed country) রূপান্তর করতে পেরেছিলেন। আর কন্যার হাত ধরে বাংলাদেশে উন্নয়নশীল (developing) দেশের কাতারে শামিল হওয়ার জন্য প্রস্তুত।
পিতার হত্যার পর শেখ হাসিনা দীর্ঘ ছয় বছর ভারতে নির্বাসনে ছিলেন। দেশে আসতে চেষ্টা করেছিলেন কয়েকবার। জেনারেল জিয়ার আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে তিনি দেশে আসতে পারেননি। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন তাঁকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়, তখন জিয়া বাধ্য হন শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরার অনুমতি দিতে। ১৯৮১ সালের ১৬ মে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেশে ফেরেন।
শেখ হাসিনার ভাগ্য খারাপ বলতে হবে, কারণ তাঁকে বেশি দিন জিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়নি। শেখ হাসিনা দেশে ফেরার কিছুদিন পরই জিয়া চট্টগ্রামে একদল সেনা সদস্যের হাতে নিহত হন। কিছুদিন পর ক্ষমতা দখল করলেন জিয়ার উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদ। তাঁর বিরুদ্ধে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে মিলে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৯ বছর আন্দোলন করেছেন। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদের পতন হলে ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে সরকার গঠন করে। হাল ছাড়েননি শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ তাঁর নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে। এর পর থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের বদলে যাওয়ার পালা। যে বাংলাদেশকে জিয়া আর তাঁর স্ত্রী মিলে মিনি পাকিস্তান বানিয়েছিলেন, সেই বাংলাদেশকে তিনি আবার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা শুরু করলেন। সংবিধান থেকে ইনডেমনিটি বা ১৫ই আগস্টের ঘাতকদের নরহত্যার জন্য দায় মুক্তি আইন বাতিল হলো। শুরু হলো বঙ্গবন্ধু আর পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচারকাজ। এই দফায় তিনি আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাতে নিয়েছিলেন আর তা হচ্ছে কৃষি উন্নয়ন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলার প্রাণ হচ্ছে এই দেশের কৃষক। আজ বাংলাদেশ একটি খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ। এই কৃতিত্বের দাবিদার একমাত্র শেখ হাসিনা। পিতার অনেক স্বপ্ন তাঁর হাত ধরেই বাস্তবায়িত হয়েছে। পিতার সময় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ২০০ ডলারের মতো। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৮০ ডলারে। যাত্রার সময় দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, যা এখন ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। যে দেশে ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল একটি মারাত্মক সমস্যা, সেই দেশ বর্তমানে প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে; যদিও বিতরণ করতে পারে ১০ থেকে ১২ হাজার মেগাওয়াট। ৯৯ শতাংশ বাড়িতে এখন বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। খালেদা জিয়া দুই দফায় সম্পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি সর্বোচ্চ তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পেরেছিলেন।
শেখ হাসিনার জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনে যোগ দেওয়াটা ছিল একটা মাইলফলক। এই অধিবেশনে বাংলাদেশ এসডিজি অর্জনে তাক-লাগানো অগ্রগতির জন্য শেখ হাসিনাকে দেওয়া হয় এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার (SDG Progress Award) । এই পুরস্কারে যখন তাঁকে ভূষিত করা হচ্ছিল তখন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলেছেন, ‘রাজমুকুটে আজকের দিনের জন্য তিনি (শেখ হাসিনা) একটি উজ্জ্বল হিরের টুকরা (Jewel in the crown of the day) । যেকোনো বাঙালিকে বিশ্বসভায় দেশের প্রধানমন্ত্রীকে এমন একটি অভিধায় পরিচয় করিয়ে দিলে তা গর্বিত করে।
শুক্রবার নিউ ইয়র্ক সময় সকাল ১১টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় তাঁর পূর্বনির্ধারিত ভাষণ দিলেন। আজ থেকে ঠিক ৪৭ বছর আগে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো এই বিশ্বসভায় এই দেশের পক্ষে তাঁর প্রথম ভাষণটি দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু সারা বিশ্বে শান্তি ও ন্যায়নীতির সংগ্রামের কথা বলেছিলেন। বিশ্বসভায় তিনি শুনিয়েছিলেন শান্তির বাণী। ভারত উপমহাদেশে চলমান অশান্তির কথা তুলে ধরতে বঙ্গবন্ধু ভোলেননি। এসবের জন্য তিনি বিশ্বের ধনী দেশগুলোর দায়িত্বের কথা বলতে ভোলেননি।
ঠিক ৪৭ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা অনেকটা পিতার কথাকেই ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি জোর দিয়েছেন বাংলাদেশে অবস্থানরত ১০ লাখের বেশি মিয়ানমার থেকে উচ্ছেদ হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সেই দেশের মানুষের নিজ দেশে সম্মানের সঙ্গে ফেরত যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির কথা। এর আগে তিনি ভিন্ন আরেকটি সভায় জাতিসংঘে উপস্থিত হয়ে অনেকটা হতাশার সুরে বলেছেন, ‘বিশ্বে অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই শরণার্থীদের কথা উঠলে অনেক কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয় না।’ বিশ্বসভার প্রতিটি সভায় তিনি জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার ফলে বিশ্বের দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কার কথা তুলে ধরেছেন। এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা কভিড-১৯ অতিমারিজনিত সমস্যা এবং এই অতিমারি সমাধানের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে টিকা। শেখ হাসিনা বলেছেন, এই টিকা নিয়ে টিকা প্রস্তুতকারী দেশগুলোর ভূমিকা হতাশাজনক। যেখানে অনেক দেশে ১ শতাংশ মানুষও টিকা পায়নি, সেখানে উন্নত বিশ্ব এই টিকা নিয়ে ব্যবসা করতে বেশি আগ্রহী। আফ্রিকার অনেক দেশ, যেখানে মানুষ এক ডোজ টিকাও পায়নি, সেখানে কোনো কোনো উন্নত দেশ তৃতীয় ডোজ টিকা দেওয়ার কাজ শুরু করেছে, যা গুরুতর অন্যায়। তিনি বারবার টিকাকে উন্মুক্ত বিশ্বসম্পদ ঘোষণা করার দাবি তুলেছেন এবং টিকার ওপর আরোপিত মেধাস্বত্ব আইন তুলে নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। পিতার মতো কন্যাও বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের কথা বলতে ভোলেননি। এই দিন শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন তিনি শুধু বাংলাদেশর জন্যই আশীর্বাদ নন, তিনি বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের জন্যও আশীর্বাদ। তাদের হয়ে শুধু বিশ্বসভায়ই নয়, তিনি সুযোগ পেলে যেকোনো সভায় তাদের কথা বলতে ভোলেন না।
স্বাধীন বাংলদেশের বয়স ৫০ পার হয়েছে। এই ৫০ বছরে একাধিক সামরিক ও বেসামরিক সরকার দেশ শাসন করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসন ও শেখ হাসিনার এই দফায় প্রায় ১৩ বছরের শাসন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালজয়ী অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। যে দেশটির জন্মের সময় তাঁর ভবিষ্যৎ ছিল অনেকটা অন্ধাকারচ্ছন্ন সেই দেশ এখন সারা বিশ্বে একটি বিস্ময়। যে মেয়েটি একদিন ডাক্তার বা স্কুল শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন, সেই শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, একজন বিশ্বস্বীকৃত রাষ্ট্রনায়ক। পিতার সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে বাংলাদেশকে বিশ্বের অনেক দেশ চিনত ‘মুজিব কান্ট্রি’ হিসেবে। এখন সেই একই দেশকে আর ভিন্নভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না, কারণ বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে এই দেশ এখন সারা বিশ্বে এক নামে পরিচিত। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, বাংলাদেশের ক্রিকেট, জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের সরব উপস্থিতি, বাংলাদেশে নারীর বিস্ময়কর ক্ষমতায়ন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কভিড-১৯ অতিমারি মোকাবেলায় আগাম সতর্কতা ও ব্যবস্থা—সব কিছুই সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বাংলাদেশ যেতে পারত আরো অনেক দূর; কিন্তু পারেনি অতিমাত্রায় আমলাতান্ত্রিকতা ও দুর্নীতির করাল থাবার কারণে। এই দুই সর্বনাশা সমস্যার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ক্লান্তিহীনভাবে লড়াই করেছেন; কিন্তু খুব বেশি দূর অগ্রসর হওয়ার আগেই জীবন দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে কখনো জনগণ থেকে কেউ বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। কিন্তু এই কথাটি তাঁর কন্যার বেলায় তেমন জোরালোভাবে বলা যাবে না। তাঁর চারপাশে এক শ্রেণির আমলা আর তোষামোদকারী একটি অদৃশ্য দেয়াল সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, যার ফলে তিনি এখন সহজে জনগণের কথা শুনতে পারেন না। আজকের এই দিনে এটাই শপথ হোক—সব জাল ছিন্ন করে জননেত্রী আবার জনগণের মাঝে ফিরে আসবেন, শুনবেন তাদের কথা, জানবেন তারা কী চায় আর তাঁর চিরাচরিত অভ্যাসমতো তাদের সেই চাহিদা পূরণ করবেন। আবারও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে তাঁর সব অর্জনের জন্য টুপি খোলা অভিনন্দন। শুভ জন্মদিন জনগণের ‘আপা’ শেখ হাসিনা। আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি। দেশের জন্য জনগণের জন্য আপনি এখনো অপরিহার্য।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Source: kalerkantho.com, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১
Link: https://www.kalerkantho.com/print-edition/special-kalerkantho/2021/09/28/1077739