A Writing of Professor Abdul Mannan Sir at the Daily Samakal দু’জন মুক্তিযোদ্ধার বিদায়

A Writing of Professor Abdul Mannan Sir at the Daily Samakal দু’জন মুক্তিযোদ্ধার বিদায়

  ঢাকা    মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০১৯,৪ অগ্রহায়ণ ১৪২৬

 

মুক্তমঞ্চ

 

দু'জন মুক্তিযোদ্ধার বিদায়

দু’জন মুক্তিযোদ্ধার বিদায়

সমকালীন প্রসঙ্গ

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০১৯

একদিনের ব্যবধানে দেশের জন্য জীবন বাজি রাখা দু’জন বীর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলেন। প্রথমজন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও অবিভক্ত ঢাকার শেষ মেয়র সাদেক হোসেন খোকা আর দ্বিতীয়জন চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য মইনউদ্দীন খান বাদল। সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। মইনউদ্দীন খান বাদল আমার কাছে ‘বাদল ভাই’। সংসদে বা সংসদের বাইরে মইনউদ্দীন খান বাদলের বিকল্প একজন মানুষ পেতে বাংলাদেশকে বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

সাদেক হোসেন খোকা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর দেশ ত্যাগ করেছিলেন। কারণ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ ছিল। ২০১৩ সালে ঈদের আগে তিনি কিশোরগঞ্জের এক জনসভায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে রাজি না হয়, তাহলে ঈদের পর এমন আন্দোলন গড়ে তোলা হবে যে, আকাশে কাকপক্ষীও উড়বে না। তিনি দেশত্যাগ করে থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। শরীরে বাসা বেঁধেছিল ক্যান্সার। ভুগেছেন অনেক দিন, তারপর মৃত্যু। বাংলাদেশের পাসপোর্ট সারেন্ডার করে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন; ঠিক যেমনটি করেছেন তারেক রহমান। বিএনপি যেহেতু এখন একটি ডুবন্ত তরী, সে কারণে সবকিছু নিয়ে তারা রাজনীতি করতে চেষ্টা করে। মৃত সাদেক হোসেনও তা থেকে বাদ যাননি। তাদের হয়তো মনে নেই, মেজর জলিল একাত্তরের একজন সেক্টর কমান্ডার ও জাসদের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা ও সভাপতি সেই পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ১৯ নভেম্বর ১৯৮৯-এ মৃত্যুবরণ করেছেন, যেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন। মেজর জলিলকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া জেলে পুরেছিলেন। সাদেক হোসেন খোকা দেশে ফিরতে যখন চেয়েছেন তখন সরকার ঘোষণা করেছে, তার দেশে ফেরার সুবিধার্থে তাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেওয়া হবে।

সাদেক হোসেন খোকা ঢাকায় গেরিলা অপারেশনের জন্য খ্যাত ক্র্যাক প্লাটুনের চৌকস সদস্য ছিলেন। ছাত্রজীবনে চীনপন্থি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সময়ে তিনি বিরোধী শিবিরে যোগ দেন। একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি প্রতি বছর নগর ভবনে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলন মেলার আয়োজন করতেন। ঢাকার অনেক সড়ককে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করেন। এসব কীর্তির কারণে তিনি মানুষের মনে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন। কিন্তু এই একই সাদেক হোসেন খোকাকে সংকীর্ণ রাজনীতির কারণে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী বা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে সংসদে বা মন্ত্রিসভায় বসতে হয়েছে। খোকার আর একটি বড় ভাগ্য হচ্ছে, তার মরদেহ আনা থেকে শুরু করে তার জানাজা, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার যেসব সম্মাননা পাওনা, যেমন গার্ড অব অনার, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন, কোনো কিছুতেই সরকার সহযোগিতা করতে কার্পণ্য করেনি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এগুলো তার প্রাপ্য। এখানেই শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার তফাত।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কথা সবার মনে আছে নিশ্চয়। মুক্তিযুদ্ধে তিনি তার সন্তান রুমীকে হারিয়েছিলেন। রুমীও খোকার মতো ঢাকার একজন গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়লে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর খালেদা জিয়া সরকার গঠন করে প্রথমে যে ক’টা অপকর্ম করেছিলেন, তার একটা ছিল একাত্তরের ঘাতকদের প্রধান সেনাপতি গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান। এই ঘাতকদের প্রতিহত করতে শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। গঠিত হয় গণতদন্ত কমিটি। প্রতীকী মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় একাত্তরের ঘাতকদের। খালেদা জিয়া শহীদ জননী ও তার ২১ জন সহকর্মীর বিরুদ্ধে রুজু করেন রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। শহীদ জননী ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান শহরে তার আর এক সন্তানের বাসায় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা মাথায় নিয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মরদেহ দেশে আনা হয়। তখন খালেদা জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতায়। কেউ কেউ দাবি করেন, যেন শহীদ জননীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। একজন ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলার আসামিকে কীভাবে এ সম্মান দেওয়া যাবে- প্রশ্ন সরকারের! সেই সম্মান দিয়েছিল এ দেশের জনগণ। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে লাখো মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সমাহিত হয়েছিলেন। সাদেক হোসেন খোকা একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।

 

মইনউদ্দীন খান বাদল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আর একজন সূর্য সৈনিক। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। একাত্তরে তার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল প্রথম দিন থেকেই। জানেন তিনি মেজর জিয়ার যুদ্ধদিনের প্রথমদিকের অনেক কথা। এসব কথা তিনি যখন সংসদে দাঁড়িয়ে বলতেন, তখন সংসদ গমগম করত। সবাই পিনপতন নীরবতার মধ্যে তা শুনতেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভারতের চলচ্চিত্রশিল্পী শাবানা আজমির পিতা কবি কায়ফি আজমির কবিতা উদ্ৃব্দত করে যখন বক্তৃতা শুরু করতেন অথবা যখন বলতেন, ধর্ষক আর ধর্ষিতা এক রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারে না, তখন সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতেন। যখন তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘শেখ মুজিব ওয়াজ দি ফিজিক্যাল এমবডিমেন্ট অব ইন্ডিপেনডেন্স’, তখন শেখ হাসিনাও চোখের জল ধরে রাখতে পারতেন না। তিনি একবার বিমানবন্দরের লাউঞ্জে আমাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যখন মনে করেন, কোনো একটা ইস্যু নিয়ে সংসদে আমি কথা বলি, তিনি আমাকে খবর পাঠাতেন। পিতার মতো কন্যাও জানতেন, কাকে দিয়ে কী কাজ হবে। বাদল ভাইয়ের অনুপস্থিতি সংসদে অনেক কাল ধরে পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না।

স্বাধীন বাংলাদেশে মইনউদ্দীন খান বাদলের রাজনীতি শুরু জাসদ দিয়ে। এর পূর্বে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত একজন তরুণ রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তবে তিনি একাধিকবার অকপটে স্বীকার করেছেন, জাসদের রাজনীতিতে কী কী ভুল ছিল এবং সেসব ভুলের জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন। বাদল ভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশিরভাগ সময় দেখা হতো বিমানবন্দরে অথবা কোনো টিভি টক শোতে। একটি কারণে তার কাছে আমি ঋণী। বঙ্গবন্ধু প্রণীত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন আইন-১৯৭৩কে যুগোপযোগী করে কমিশনকে হায়ার এডুকেশন কমিশনে রূপ দেওয়ার দাবি অনেক দিনের। আমি দায়িত্ব নিলে পুনরায় চেষ্টা শুরু হলো। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টা উত্থাপন করলে তিনি অবাক হলেন- এখনও কেন তা হচ্ছে না! তার অভয় পেয়ে আবার চেষ্টা শুরু। বিষয়টা মন্ত্রিসভায় উঠলে সবাই এই অনুশাসন দিলেন, যেন নতুন আইনে কোনো অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর হাতে করা আইনের ব্যত্যয় ঘটে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত না হয়। মঞ্জুরি কমিশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সচিব কমিটি ঘন ঘন বৈঠক করে। প্রতিনিধিরা এসে আমাকে বেশ আশার কথা শোনান। সব শেষে যখন খসড়া চূড়ান্ত হয়, তখন দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর করা আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি একটি খসড়া দাঁড় করানো হয়েছে। মঞ্জুরি কমিশনকে একটি সরকারি অধিদপ্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর পর বিষয়টি আবার মন্ত্রিসভায় যাবে। তারপর সংসদে উত্থাপিত হবে। এর পর সংসদীয় কমিটি হয়ে সংসদ। আমার দৌড় সংসদীয় কমিটি পর্যন্ত।

মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের সঙ্গে দেখা করে তাদের পুরো বিষয়টা অবহিত করি এবং একটি ওয়ার্কিং পেপার তৈরি করে দিই। এর পর যাই বাদল ভাইয়ের কাছে। তিনি আমাকে অভয় দেন- যদিও তিনি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নন, তারপরও বিলটি সংসদে উঠলে কেন এই বিল এভাবে পাস হওয়া উচিত নয়, তা তিনি তুলে ধরবেন। তিনি আশা করেন, হাউস তার সঙ্গে একমত হবেন। গত ৮ মার্চ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ওপর মূল প্রবন্ধ ছিল আমার। প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আমার কাছে আবারও জানতে চান, ওই আইনের কী হলো? তাকে সংক্ষিপ্তভাবে যতদূর সম্ভব বলি। তিনি বলেন, তিনি তা দেখবেন। এর পর তো আমি দায়িত্বে নেই। বাদল ভাইয়ের চলে যাওয়ার পর নিজেকে প্রশ্ন করি- বাদল ভাই, আপনিও চলে গেলেন আমিও আর ওই দায়িত্বে নেই। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সময় হলে কে আর আপনার মতো এটির স্বার্থ রক্ষা করার কথা বলতে পারবেন? বাদল ভাই, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। দুই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
 
বিশ্নেষক ও গবেষক

https://samakal.com/todays-print-edition/tp-muktomoncha/article/19118185

Add a Comment