ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস ও একজন সুভাষ মল্লিক
আবদুল মান্নান
ইতিহাসের প্রয়োজনে প্রবাসী অথবা বিকল্প সরকার গঠন করার অনেক নজির আছে। কখনো কখনো কোনো একটি রাষ্ট্র অন্য আরেকটি রাষ্ট্রকে দখল করে নিলে সেই রাষ্ট্রের বৈধ সরকার দেশ ত্যাগ করে প্রবাস থেকে নিজ দেশের সরকার পরিচালনার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার ঝটিকা আক্রমণ করে ইউরোপের অনেক দেশ দখল করে নিলে সেসব দেশের বৈধ সরকার নিজ দেশ ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে গিয়ে প্রবাসী সরকার হিসেবে নিজ দেশের মানুষকে শত্রুমুক্ত করার চেষ্টা করে। চেষ্টা সফল হলে এসব সরকার সগৌরবে নিজ দেশে ফিরে আসে। আবার কখনো কখনো নানা কারণে নিজ দেশের সরকারকে দেশের কিছু মানুষ বা কোনো এক বা একাধিক গোষ্ঠী যেকোনো কারণে অবৈধ মনে করলে (যেমন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি বা পরাজয়ের পরও ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকার করা) তখন আর এক বা একাধিক দল বিকল্প সরকার গঠন করতে পারে। অফ্রিকার অনেক দেশে বর্তমানে গৃহযুদ্ধ চলছে। সেখানে কোনো একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী একটি অঞ্চল দখল করে অনেক সময় সেখানে পাল্টা সরকার গঠন করে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা যে সরকার গঠন করেছিলেন (মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিত) তার ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদের নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি
আসনে জয়ী হলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গণতান্ত্রিকব্যবস্থার রীতিনীতি বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করবে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলারা চিন্তাই করতে পারেন না, পাকিস্তান শাসনের ভার বাঙালিদের হাতে চলে যাবে। শুরু হয় নানা টালবাহানা। পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার নামে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কাজ শুরু করেন এবং ১৯৭১ সালের ২৫/২৬ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর সূচনা করেন, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব বাংলাকে বাঙালিশূন্য করা। ইয়াহিয়া খানের জন্য এটি স্বাভাবিক ছিল যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করবে নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করে এবং একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত পাকিস্তানের গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের হয় হত্যা করতে হবে অথবা বন্দি করতে হবে। অপারেশন সার্চলাইট শুরুর প্রাক্কালে বাঙালি বুঝতে পেরেছিল একটি মুক্তিযুদ্ধ আসন্ন এবং যে যার মতো প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের প্রথম লক্ষ্য ছিল দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে পরবর্তী কর্মসূচি প্রস্তুত করা। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে কী হতে যাচ্ছে বা হতে পারে সে সম্পর্কে ভারত, বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি পরিষ্কার ধারণা ছিল এবং তিনি সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের এ সম্পর্কে আগে থেকেই সতর্ক করে রেখেছিলেন।
বাংলাদেশে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, নির্বাচিত সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ ঝিনাইদহে পৌঁছে যান। তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় মেহেরপুরের মহকুমা অফিসার (এসডিও) তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা) ও মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবউদ্দিন আহমদের সঙ্গে। তাঁদের সহায়তায় আওয়ামী লীগের এই দুই সংসদ সদস্য কলকাতায় চলে যান। তাঁদের সার্বিক সহায়তা করেন বিএসএফের শীর্ষ দুই কর্মকর্তা—জেনারেল রুস্তমজি আর গোলক মজুমদার। তাঁদের সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের নেতাদের যোগাযোগ হয়। তাদের পরামর্শে তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম ২ এপ্রিল দিল্লিতে উপস্থিত হয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের এই ক্রান্তিকালে তাঁর সরকারের পরামর্শ ও সাহায্য চান। জবাবে ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের পরামর্শ দেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে তাঁরা যেন দ্রুত একটি সরকার গঠন করেন। কলকাতায় ফিরে এসে এই দুই নেতা যেসব জনপ্রতিনিধি সীমান্ত পার হতে পেরেছেন তাঁদের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সমবেত হতে বলেন। ১০ এপ্রিল সমবেত জনপ্রতিনিধিরা সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন এবং একই সঙ্গে কী প্রেক্ষাপটে এই সরকার গঠন করা হয়, তা ব্যাখ্যা করতে একটি প্রস্তাবনা প্রস্তুত করেন। এই প্রস্তাবনাটি মূলত প্রস্তুত করেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও তাঁর অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। গণপরিষদ সদস্য কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। সরকার গঠনের এই সংবাদটি ভারতের আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হলেও সে সম্পর্কে খুব বেশি মানুষ জানতে পারেনি। তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁদের কোনো কমান্ড কাঠামো না থাকায় যুদ্ধ চালাতে বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল। বিশ্ববাসীর কাছে এটি প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল যে বাংলাদেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একটি বৈধ সরকার গঠন করেছে; কারণ সেই সময় নির্বাচিত জনপ্রনিধি ছাড়া অন্য কারো সরকার গঠন করার সুযোগ ছিল না। এই একই কারণে মার্চের ২৭ তারিখে যখন মেজর জিয়া প্রথমে নিজেকে বিপ্লবী সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করেন তখন চট্টগ্রামের স্থানীয় নেতারা তাঁকে মনে করিয়ে দেন, এটি কোনো সেনা অভ্যুত্থান নয় যে তিনি জনগণের কোনো ম্যান্ডেট ছাড়া নিজেকে সরাসরি রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করতে পারেন। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি এ কে খান। পরে জিয়া নিজের ভুল বুঝতে পেরে পরের ঘোষণায় বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এই ঘোষণ দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে জিয়া তাঁর জীবদ্দশায় কখনো নিজেকে তথাকথিত স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি।
১৯৭১ সালে পাবনার জেলা প্রশাসক ছিলেন মোহাম্মদ নুরুল কাদের খান, যিনি স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশে শতভাগ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের ভিত্তি রচনা করেছিলেন (দেশ গার্মেন্টস)। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে তিনি আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের একটি গ্রিন সিগন্যাল হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। সেইমতে, তিনি জেলার আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, বাঙালি জনগণ, পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ নুরুল কাদের খানের নিয়ন্ত্রণে জেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। উভয় পক্ষে ক্ষয়ক্ষতি হলেও যোদ্ধারা সঠিক দিকনির্দেশনা পাচ্ছিলেন না। ১৩ এপ্রিল নুরুল কাদের নিশ্চিত হন যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি সরকার গঠন করা হয়েছে এবং এখন থেকে সবাইকে সেই সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক নির্দেশনা দেবেন সরকারের সেনাপ্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে সরকারটি গঠন করা হয়েছে তা বহির্বিশ্বে তেমন একটা প্রচার পায়নি। এটিকে কার্যকর করতে হলে এর দ্রুত প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ১৩ এপ্রিলই নুরুল কাদের খান ও তৌফিক-ই-এলাহীর সঙ্গে মেহেরপুরে দুজন ভারতীয় বিএসএফ অফিসারের সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা ছিলেন রুস্তমজি আর গোলক মজুমদার। তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে এসেছেন স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কিছু জরুরি বিষয়ে আলোচনা করতে। তাঁরা (নুরুল কাদের খান ও অন্যরা) বললেন, বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিরা সরকার গঠন করেছেন এবং তা রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে ঠিক, কিন্তু সেই সরকারকে যদি গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হয় তার আরো ব্যাপক প্রচার দরকার এবং তার জন্য কিছু আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন। ভারত থেকে আসা বিএসএফ কর্মকর্তারা জানালেন, এই আনুষ্ঠানিকতা ভারতের মাটিতে করলে অসুবিধা হতে পারে; আর সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে করলে তা নিরাপত্তার ঝুঁকির কারণ হতে পারে। নুরুল কাদের অভয় দিয়ে বললেন, তাঁর নিয়ন্ত্রণে ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা আছেন। নিরাপত্তার ভার তিনি নেবেন। ফিরে গেলেন ভারতীয় কর্মকর্তারা। ১৬ এপ্রিল রাত ১টা-দেড়টার মধ্যে সংবাদ এলো, পরদিন বাংলাদেশের কিছু নেতা আসবেন এবং এলাকায় একটি সভা হবে। এই সভার জন্য সকালে স্থান নির্বাচিত হলো বৈদ্যনাথতলা গ্রামের একটি আমবাগানে। স্থানটি সীমান্ত থেকে আধা কিলোমিটার দূরে।
কয়েক সপ্তাহে আগে গিয়েছিলাম বৈদ্যনাথতলার সেই ঐতিহাসিক স্থানে। আমাদের দেখে একজন সত্তরোর্ধ্ব মানুষ এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তাঁর নাম সুভাষ মল্লিক। স্থানীয় অধিবাসী। জাতে খ্রিস্টান। একাত্তরের ৭ মার্চে তিনি মোংলা বন্দরে শ্রমিকের কাজ করতেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি বন্দরের কাজ ফেলে নিজ বাড়ি বৈদ্যনাথতলায় চলে আসেন। ১৭ এপ্রিল সকাল থেকেই শোনেন কেউ একজন মাইকযোগে প্রচার করছে, সকাল ১১টায় বৈদ্যনাথতলায় এক জনসভা অনুষ্ঠিত হবে এবং সেখানে বাংলাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা বক্তব্য দেবেন। পাশেই একটি খোলা জায়গায় চৌকি দিয়ে মঞ্চ তৈরি হচ্ছিল। সুভাষ মল্লিক ও আরো কয়েকজন মিলে কিছু চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা করলেন স্থানীয় গির্জা ও স্কুল থেকে। দু-একটি চেয়ার মানুষের বাড়ি থেকেও এলো। দেখতে দেখতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওই স্থানে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেল। প্রায় হাজার পাঁচেক হবে। সবার একটাই প্রশ্ন—কে আসছেন এই সভায়? চারদিকে তখন গগনবিদারী স্লোগান ‘জয় বাংলা’ শুরু হয়ে গেছে। সকাল ১১টার কিছু আগেই সীমান্ত পার হয়ে কয়েকটি গাড়িতে ভারতীয় ও বিদেশি সাংবাদিকদের নিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীনসহ অন্যান্য নেতা সভাস্থলে পৌঁছালেন। নেতারা দ্রুত মঞ্চে উঠে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। শপথবাক্য পাঠ করালেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মহকুমা পুলিশ অফিসার মাহবুবউদ্দিন আহমদ কিছু পুলিশ ও আনসার সদস্যকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভাকে গার্ড অব অনার দেন। বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ হলো মুজিবনগর। সেই থেকে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রচলিত নাম মুজিবনগর সরকার। সেই দিনের দৃশ্য ছিল অভূতপূর্ব ও ঐতিহাসিক। সুভাষ মল্লিক মুজিবনগরে আসা অতিথিদের নিয়মিত সেদিনের কাহিনি শোনান। কথা বলার সময় এই বয়সেও তাঁর বুকটা ফুলে ওঠে। বলেন, তাঁর আফসোস এ পর্যন্ত কোনো সরকার তাঁর কোনো খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় তৃপ্তি তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি ক্ষুদ্র অংশ হতে পেরেছেন। এলাকায় আরো কয়েকজন সুভাষ মল্লিকের মতো মানুষ আছেন।
সরকার শপথ নেওয়ার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বেশ তেজোদীপ্ত ও উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দেন। তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর বক্তৃতার সময় নবনিযুক্ত সেনাবাহিনীপ্রধান কর্নেল ওসমানীকে পরিচয় করিয়ে দেন। সেদিনের সমগ্র কর্মকাণ্ড উপস্থিত সাংবাদিকরা কলকাতায় ফিরে গিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেন। বিশ্ব জানতে পারে একটি নতুন দেশের সূচনালগ্নের অমর ইতিহাস। পুরো অনুষ্ঠান ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে শেষ করে নেতারা সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যান। পরবর্তী ৯ মাস তাঁদের সব দাপ্তরিক কর্মকাণ্ড মুজিবনগরের নামে কলকাতা থেকে পরিচালিত হয়। নুরুল কাদের খানকে পাকিস্তানের সামরিক আদালত আরো কয়েকজন সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। যদিও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা একটি বৈধ সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু কিছু উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন বলেও জনশ্রুতি আছে। যদিও তাজউদ্দীন আহমেদের বিচক্ষণতা ও ভারত সরকারের মনোভাবের কারণে তা সম্ভব হয়নি। অনেকে হয়তো জানেন না, সেনাবাহিনীর সদস্যসহ যাঁরা সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তা ছিলেন তাঁরা যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তা বোঝানোর জন্য সবাইকে প্রতীকী মাসোয়ারা দেওয়া হতো। এই দিনে সব বীরকে অভিবাদন। এই সরকারই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছে, অনেক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেছে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় যাঁরাই উপিস্থত ছিলেন, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন তাঁরা সবাই ইতিহাসের একেকজন বীর।
ঐতিহাসিক পলাশী থেকে মুজিবনগরের দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। ২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ পাঠ ও বিপ্লবী সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আবার সে সূর্য উদিত হয়।