প্রতিরক্ষা সহযোগীদের প্রতিযোগিতার মুখে বাংলাদেশ
মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ
১৯৭১ সালে বিশ্বের পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধ যখন তুঙ্গে তখন রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নিলেও কেউ ভাবতেও পারেনি দেশটি সাড়ে চার দশকে এসে উন্নয়ন ও অগ্রগতির আইকন হয়ে দাঁড়াবে। দরিদ্রতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত দেশটির ক্ষুধা মেটাতে বিদেশের দ্বারে-দ্বারে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরতে হতো। বিদেশি সাহায্য সময়মত না এলে দুর্ভিক্ষ ছিল অবশ্যম্ভাবী। স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য একটি সক্ষম প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলার পূর্ণ সামর্থ্য না থাকলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে জন্ম নেওয়া সামরিক বাহিনী হাঁটি হাঁটি পা পা করে দেশের উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মিশর সফরে গিয়ে ট্যাংকের প্রথম সংগ্রহ এনেছিলেন। তারপর ধীরে-ধীরে সাজ সরঞ্জাম ও যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি বাড়তে থাকে কলেবর।
প্রচলিত অস্ত্রের সরবরাহ এসেছে সবচেয়ে বেশি চীন থেকে যার অধিকাংশই ছিল ব্যবহূত নতুবা অত্যাধুনিক নয়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্রাস্ত্র কিনতে ও পরে উত্পাদন করতে পারলেও ভারি অস্ত্র দিতে কোনো দেশের আগ্রহের দেখা মেলেনি। নগদ টাকায় ক্রয় সম্ভব হলেও সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা চাহিদা মেটাতে পারেনি। অস্ত্রের সাশ্রয়ী যোগান এসেছিল চীন থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাশিয়া থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে কেনা মিগ ২৯ যুদ্ধ বিমান ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রের প্রথম সংযোজন।
ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেতু হিসেবে বাংলাদেশের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। ৪০৯৬ কিলোমিটারের বিশাল সীমান্ত দিয়ে তিন দিক দিয়েই ঘিরে রেখেছে ভারত। পূর্বদিকে অল্প সীমানা রয়েছে মিয়ানমারের সাথে। কিন্তু দক্ষিণের খোলা বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের বিশাল জলরাশি বাংলাদেশকে করেছে সম্পদশালী। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের আধার, চীন, জাপান ও ভারতসহ এশিয়ার দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং ভবিষ্যত্ বাণিজ্যের নৌপথ হিসেবে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব যতই বেড়েছে বাংলাদেশে ততই আগ্রহী চোখের সমাহার ঘটে চলেছে। বাংলাদেশ শুরু থেকেই কারো সাথে বৈরিতা নয় সকলের সাথে বন্ধুত্বের সরল পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করলেও বন্ধুরা সরলভাবে কাছে আসেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি ঘুরিয়েছে। পাকিস্তানি তত্পরতা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে থেকেছে।
ভারত মহাসাগর যে নিয়ন্ত্রণ করবে সে ভবিষ্যতের বিশ্ব নিয়ন্ত্রক হবে এই ধারণা এখন সবাই বিশ্বাস করে। ভারত মহাসাগরে আধিপত্য স্থাপন করার জন্য পরাশক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতা এখন সুস্পষ্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র “এশিয়া পিভট” কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে। চীন এবং ভারত উদীয়মান শক্তি হিসেবে পারস্পরিক স্বার্থ ধরে রাখতে দ্বান্দ্বিক অবস্থানে রয়েছে। দুটি রাষ্ট্র প্রতিবেশী হলেও ভারত মহাসাগরের মধ্যমনি হিসেবে ভারতের অবস্থান কিন্তু চীনের ভূখণ্ড ভারত মহাসাগরের উপকূল ধরতে পারেনি। ভারত সংলগ্ন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিজ বলয়ে নিয়ে ভারত মহাসাগরের আধিপত্য সুবিধা নিতে কৌশল তৈরি করেছে সুচারুভাবে।
চীনকে কোণঠাসা করতে অপর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বেড়েই চলেছে। মার্কিন কংগ্রেসে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সামরিক সহযোগী হিসেবে ঘোষণা করে বিল পাস হয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জন কেরি ভারত সফর করেন এবং একই সময়ে দুই দেশ লজিস্টিক্স সাপোর্ট চুক্তি সই করে। এক দেশের সেনা, নৌ ও বিমান অপর দেশের ঘাঁটিতে রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা নিতে পারবে। এটি সামরিক চুক্তির কাছাকাছি হলেও ভবিষ্যত্ সামরিক বলয় তৈরিতে বেশ এগিয়ে গেল। বাংলাদেশের সাথে একই ধরনের চুক্তি করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে ঘাঁটি নির্মাণের মার্কিন সদিচ্ছার কথা অনেক আগে থেকে শোনা গেলেও আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশ সন্তর্পণে এড়িয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের সাথে মার্কিন সামরিক সহযোগিতা প্রশিক্ষণ, বিশ্বশান্তি রক্ষা, দুর্যোগ মোকাবিলা, সন্ত্রাস দমনে সীমাবদ্ধ রয়েছে। ইদানীংকালে যোগ হয়েছে সমুদ্র সম্পদ রক্ষা। বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের তিন স্তর ভিত্তিক সহযোগিতা চলমান রয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্বের নামে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ভেটোর কারণে বাংলাদেশের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সাথে সামরিক সম্পর্ক গাঢ় হয়। চীনের পরেই রাশিয়া বাংলাদেশে যুদ্ধাস্ত্রের সরবরাহকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়। ২০১৩ সালে রাশিয়া বাংলাদেশকে যুদ্ধাস্ত্র কেনার জন্য বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা দিয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় সামরিক সাহায্য হিসেবে পরিগণিত। যার মধ্যে অত্যাধুনিক জেট ট্রেনার ও হেলিকপ্টার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
চীনের প্রেসিডেন্টের ৩০ বছর পর বাংলাদেশ সফর এবং ২৫ বিলিয়ন ডলারের অনেকগুলো চুক্তি সম্পাদনের পর বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছে ভারত, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। গতমাসে চীনের তৈরি দুটি ডিজেল সাবমেরিন বাংলাদেশ গ্রহণ করলে আঞ্চলিক সামরিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ হয়। যদিও গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চীনা কোম্পানির প্রস্তাব বাংলাদেশ গ্রহণ না করায় ভারত কিছুটা স্বস্তি পেলেও বাংলাদেশের নৌশক্তি বৃদ্ধিতে চীনা যুদ্ধ জাহাজের সংযোজন শঙ্কা বাড়িয়েছে। চীন থেকে দুটি অত্যাধুনিক করভেট পেয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়াও সমুদ্র সীমানা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বিরোধের সুরাহা হয়ে যাওয়ায় প্রায় বাংলাদেশের আয়তনের সমপরিমাণ সমুদ্র এলাকার প্রতিরক্ষার জন্য কোস্ট গার্ড ইতালি থেকে পেট্রোল বোট কিনেছে। সমুদ্র সম্পদ রক্ষার জন্য আরো সামর্থ্য বৃদ্ধির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভারত মহাসাগর উপকূলীয় দেশগুলোকে নিজ বলয়ে রেখে ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ ও ভারতের প্রকৃতিজাত সুবিধাকে কাটছাঁট করতে চীনের ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশকে পেতে চায়। তাই গত চল্লিশ বছর ধরে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের সাথে সামরিক সম্পর্ক গভীর করেছে। সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহকারী হিসেবে সবার উপরে অবস্থান ধরে রেখেছে। প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিনিয়োগে বিশাল অংশীদার হয়ে সম্পর্ককে স্ট্রাটেজিক পর্যায়ে উন্নীত করেছে। ঐতিহাসিক সিল্ক রুটের পুনর্জীবন দিয়ে ভবিষ্যত্ বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর “এক বেল্ট ও এক পথ” কৌশলের স্থল ও নৌ অংশে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রীয় অবস্থানে রয়েছে।
সামরিক সরঞ্জামের জন্য চীনের উপর বাংলাদেশের নির্ভরতা কমাতে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রথমবারের মত বাংলাদেশ সফরে এসে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার গভীরতা বাড়াতে একটি রূপকল্প রেখে গেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর হবার সম্ভাবনার কথা ভারতীয় মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলদেশকে চীনের বলয় থেকে সরিয়ে আনতে ভারতের সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর বড় বাধা চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক সক্ষমতা থেকে ভারতের পিছিয়ে থাকা। চীনের মত বড় বিনিয়োগ করার অর্থনৈতিক সক্ষমতা ভারতের এই মুহূর্তে নেই। ভারতের সামরিক সামর্থ্যতা বেড়ে চললেও বাংলাদেশের সামরিক চাহিদা মেটানোর উত্পাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রশিক্ষণ, সন্ত্রাস দমন ও যৌথ মহড়া ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ভারত সামরিক সহযোগিতা চলমান থাকলেও যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহের ক্ষেত্রে একেবারেই নেই। সমষ্টিগত নিরাপত্তার ধারণা অন্য অঞ্চলে দেখা গেলেও দক্ষিণ এশিয়াতে দৃশ্যমান হতে পারেনি পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার কারণে। সাথে কাজ করেছে প্রতিরক্ষার সনাতনী ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারার ব্যর্থতা। ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় মূল্যবোধের এককেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় একসাথে লড়াই সম্ভব হয়েছিল। ভারতের দেওয়া অস্ত্র হাতে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিল। নিরাপত্তা ঝুঁকির উত্স ও মাত্রার অভিন্নতা দুই দেশকে কাছাকাছি টেনে আনলেও ভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্য সামরিক সম্পর্ক নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে যেতে পারেনি এবং পারস্পরিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারেনি।
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে চলেছে। ভারত মহাসাগরের আধিপত্যের টানাপড়েনে বাংলাদেশকে অংশীদার হিসেবে এখন অনেকেই পেতে চাচ্ছে। এক বলয়ের সামারিক সহযোগিতা অপর বলয়কে নাখোশ করে তোলে। বাংলাদেশ তার আগ্রগতি ধরে রাখা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামরিক দান্দ্বিকতার গ্যাড়াকলে পড়ে উন্নয়নের গতি হারাতে পারে। বাংলাদেশের উন্নতির সাথে সাথে সম্পদের সুরক্ষার জন্য সামরিক সামর্থ্যতা বৃদ্ধির চাহিদা যেমন সহযোগিতার মাত্রাকে চাঙ্গা করছে অপরদিকে যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের বাড়তি সক্ষমতা নতুন বাজারের সম্ভাবনা তৈরি করছে। ফলে যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জাম সংগ্রহে চীন নির্ভরতা কমাতে ভারতসহ অন্যান্য দেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে। সামরিক সহযোগিতার প্রতিযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ নিজ স্বার্থকে এগিয়ে নিতে আগের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় চলে এসেছে। প্রথাগত অস্ত্রের বাইরে গিয়ে দূরপাল্লার কৌশলগত অস্ত্র সংগ্রহ বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে। রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত এস ৪০০ মিসাইল সিস্টেম কিনছে কয়েক বিলিয়ন ডলার দিয়ে যা ভারতকে পারমাণবিক হামলা মোকাবিলায় নতুন সক্ষমতার জোগান দিচ্ছে। সামরিক সহযোগিতা নিঃসন্দেহে বন্ধুত্বের গভীরতা তৈরি করে। সমষ্টিগত প্রতিরক্ষা অনেক সাশ্রয়ী পন্থা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন আঞ্চলিকভাবে মার্কিন নির্ভরতা কমাতে সমষ্টিগত সামরিক বাহিনী তৈরির ভাবনায় মেতেছে। সামরিক সহযোগিতা চুক্তি করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা বিভিন্ন দেশের তাগিদ বাংলাদেশকে দোটানায় ফেলেছে। তবে ঝুঁকির উত্স ও মাত্রার অভিন্নতা, স্বার্থের সদৃশ্যতা ও মিলকে বিবেচনায় রেখে সাশ্রয়ী প্রস্তাব নিয়ে সামরিক সহযোগিতার ভিত তৈরি করতে হবে। অহেতুক সংঘাত এড়াতে ভারসাম্যপূর্ণ বৈদেশিক নীতি ও কৌশলী সামরিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে পারবে।
৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, দৈনিক ইত্তেফাক